Aug 7, 2018

অউ দেখো বাংলাদেশি যার

।। জাহিদ ইছলাম বড়ভূইয়া ।।

আমরা বাঙালিরা, পারি বা না পারি, আমাদের ইচ্ছে আর স্বপ্নটা আকাশছোঁয়া। এই আকাশ ছোঁয়ে দেখার ইচ্ছাটা, এই আকাশ ছোঁয়ে দেখার স্বপ্নটাই আমাদের সবথেকে বড় শক্তি। সারা বিশ্বে বাঙালির অপর নাম বিস্ময়। বিশ্বের ২১০ মিলিয়ন মানুষের প্রথম ভাষা হচ্ছে এই বাংলা, ভাষার ক্ষত্রে সমগ্র বিশ্বে সাত নম্বরে ও ভারতে দুই নম্বর স্থানে আমার ভাষা। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন থেকে শুরু করে স্বাধীন ভারতের প্রতিটি ক্ষেত্রে বাঙালির আছে এক উজ্জ্বল ইতিহাস। কিন্তু এতো সমৃদ্ধ একটি জাতি হওয়া সত্ত্বেও আসামের বাঙালিদের কেন আজ ধাপে ধাপে এতো বঞ্চনা ও লাঞ্ছনার শিকার হতে হচ্ছে? এই প্রশ্নর উত্তর নৈব্যর্ক্তিক দৃষ্টিতে অনুসন্ধানে প্রচেষ্টা করলে অনেক অপ্রিয় সত্য বেরিয়ে আসে।

সালটা তখন ২০১৩, আমি শিলচর পঞ্চায়েত রোড থেকে তরণী রোড হয়ে রাঙিরখাড়ি আসার পথে তরণী রোডের মসজিদ পেরিয়ে এক তিক্ত প্ররোচনার শিকার হয়েছিলাম! সেখানের একটি দোকান থেকে 'অউ দেখো বাংলাদেশি যার' বলে একটি কর্কশ আওয়াজ ধেয়ে এসেছিল আমার দিকে, ফিরে তাকিয়ে দেখলাম দোকানের বারান্দায় বসে আছেন কয়েকজন বয়োজ্যেষ্ঠ লোক ও যুবক। সম্ভবত কোন একজন যুবকের মুখ থেকে এই বাক্যটি ফসকে এসেছিল। তবে আমি অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থমকে গেলেও কারো মুখে কোন অনুতপ্ত ভাব দেখলাম না বরং সেখানে যারাই ছিলেন তাঁদের মুখে এক টিটকারি ভাব অবলোকন করলাম। তারপর স্বভাবজাত ভঙ্গিতে আমি বিনা প্রতিক্রিয়ায় চললাম। নিবন্ধের প্রথমেই গৌরচন্দ্রিকা ভাব দেখানোর উদ্দেশ্য না থাকলেও বাস্তব সমস্যার চিত্র পাঠকের কাছে স্পষ্ট করতেই ব্যক্তিগত বিষয়ের অবতারণা। একটি ব্যাপারে আমরা বেশ অভিজ্ঞ যে বাঙালিরা বরাবরই উগ্র জাতীয়তাবাদের করাল গ্রাসে আক্রান্ত। ওদের চোখে কখনো বরাকের বাঙালিরা 'হিন্দু বাঙালি' বা 'মুসলিম বাঙালি' হিসাবে পরিচিত নয়, এদের রক্তচক্ষুর দৃষ্টিতে আমাদের একটাই পরিচয় এবং তা হচ্ছে 'বাঙালি'। এই সহজ তত্ত্বটি বরাকের একাংশ বাঙালিরা নিজেদের রাজনৈতিক ক্ষুদ্র স্বার্থ আদায়ের জন্য কখনো হজম করতে পারেননি। উগ্র জাতীয়তাবাদীদের তালে তাল মিলিয়ে বরাকের একাংশ স্বার্থান্বেষী বাঙালির মোড়ল আসামে বাঙিলি বিদ্বেষের বীজ বোপনের কলকাটি নাড়াচ্ছে। এদের চোখে বাংলাদেশি মানেই 'তকি' 'দাড়ি' ও পাঞ্জাবীওয়ালা কিছুটা অসহায় প্রকৃতির মানুষ, তাই বরাকের এই গিরগিটি বাঙালিরাই আইএমডিটি আইন বাতিলের পর মিষ্টিমুখ করেছিল তখনকার সমুজ্জ্বলদের সঙ্গে, কিন্তু এই আইএমডিটি আইনের স্থানে আসা নাগরিকপঞ্জীর দ্বিতীয় খসড়া প্রকাশের পর সমুজ্জ্বল বাবুরা সেই আগের মতোই মিষ্টিমুখ করতে সক্ষম হলেও ভাগ্যের পরিহাসে ও সময়ের নিদারুণ পরিস্থিতিতে সমুজ্জ্বল বাবুদের সঙ্গে গিরগিটি বাঙালিদের মিষ্টিমুখের সৌভাগ্য হয়নি।
তারপর প্রথম প্রথম এনআরসির কথা আলোচনায় আসতে বেশ উল্লেসিত দেখা যেত বরাকের একাংশ বাঙালিদের, সেই উল্লাসের কারণটা ছিল বেশ স্পষ্ট। এনআরসি হবে বেশ ভাল কথা, সমগ্র মিঞাদের বাংলাদেশি সাজানোর এর থেকে সুবর্ণ সুযোগ আর কি হতে পারে! বিদ্বেষের এই বিকৃত তৃপ্তিটাই বরাকের বাঙালিদের ভঙ্গুর ও পঙ্গু করে দিয়েছে। আর এই ঐক্যহীন বরাকের বাঙালিদের পিঠে চাবুক মারার সুযোগ কখনো হাতছাড়া করেনি উগ্র জাতীয়তাবাদের পৃষ্ঠপোষকরা। এনআরসির কাজ যখন জোরকদমে চলছিল তখন অনেক অশনি সংকেত বরাকের বাঙালির সামনে ফুটে উঠলেও তখন তা পাত্তা না দিয়ে সেই গিরগিটি বাঙালিরাই তথাগত রায় ও শিলাদিত্যকে তাদের রোল মডেল হিসাবে বেছে নিয়েছিল। পুরো এন আর সির কার্যকালে বাঙালি হিন্দুদের আগলে রেখে বাঙালি মুসলিমদেরকে নিয়ে একের পর এক বিদ্বেষপূর্ণ তির্যক মন্তব্য করে শিলাদিত্য রাতারাতি হিরো হয়ে গেলেন, বাঙালির এই সংকটে শিলাদিত্যের বিষবাক্য অতি কৌশলে হজম করে নিলেন বরাকের এক শ্রেণীর একাংশ বাঙালিরা। একজন রাজ্যপাল হয়েও তথাগত রায় বরাকের হিন্দু বাঙালিদের অসমীয়াদের সঙ্গে মিশে যাওয়ার আকুতি জানান। এক প্রভাবশালী মন্ত্রী সবাইকে বারবার আশ্বস্ত করে একাধিকবার সংবাদমাধ্যমে ঘোষণা দিলেন যে সমস্যা শুধু মাদানিদের নিয়ে, অন্য কাউকে নিয়ে সমস্যা নয়। শিলাদিত্য, তথাগত রায় বা কিছু প্রভাবশালী মন্ত্রীদের ভাষ্য শুনে বরাকের একাংশ বাঙালিরা খুশিতে টগবগ করে হাবুডুবু খাচ্ছিলেন এবং অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় ছিলেন 'অউ দেখো বাংলাদেশি যার' বাক্যটি পুনরুদ্ধারের। বরাকের কিছু বুদ্ধিজীবিদের কলম তখন পত্রিকায় বিদ্বেষপূর্ণ লেখার ফুলঝুরি ছুটায়। কথায় কথায় মির্জাফরের উত্তরসুরী বলে টার্গেট করা সেই কলমচিরা তখন শিলাদিত্য ও তথাগতদের উত্তরসুরী হতে কোন খামতি রাখেননি।
এনআরসির প্রক্রিয়ার মাঝে 'হিন্দু বাঙালি নাগরিকত্ব বিল' এর তোড়জোড় সেই গিরগিটি বাঙালিদের মুখ্য খোরাক হয়ে উঠে। মোটকথা বাঙালিদের মধ্যে বিভাজন রেখা টানতে ছলে বলে কৌশলে একটাই বার্তা স্পষ্ট করার অপচেষ্টা চলছিল যে এই এনআরসি বাঙালি হিন্দুদের সম্পূর্ণ সুরক্ষা প্রদান করবে এবং বাঙালি মুসলিমদের গণহারে বাংলাদেশি তকমা দেবে। এই সুপ্ত বাসনা মনে নিয়েই কিছু বাঙালি বিভাজনের অনেক নীলনক্সা তৈরি করলেও সুপ্রিমকোর্টের তীক্ষ্ণ দৃষ্টিগোচরে পরিচালিত হওয়া এনআরসির ফাইনাল খসড়ার পরিসংখ্যান দেখে চোখ কপালে উঠে যায় বাঙালির আসল শত্রুদের। কারণ চল্লিশ লক্ষ নাগরিক যাদের নাম বিভিন্ন কারণে বাদ পড়েছে তারা কেউ হিন্দু বা মুসলমান নয়, এদের অধিকাংশের পরিচয় হচ্ছে বাঙালি। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হচ্ছে যে প্রভাবশালী মন্ত্রীরা এক সময় আশ্বাস দিয়েছিলেন যে হিন্দু বাঙালিদের কোন চিন্তার কারণ নেই সেই নেতাদের এক জাতীয় অভিভাবক রাজ্যসভার মতো পবিত্র স্থানে দাঁড়িয়ে চীৎকার করে বলে দিলেন যে আমাদের হিম্মত থাকায় আমরা এই এন আর সি বাস্তবায়ন করেছি। এতোটা কথা ঠিকই ছিল কিন্তু এর পরে এই নেতা বিরোধীদের কটাক্ষ করে বলেন যে এই চল্লিশ লক্ষ বিদেশিদের নিয়ে বিরোধীদের এতো মাথাব্যথা কেন, কোন স্বার্থে এই চল্লিশ লক্ষ বিদেশিদের জন্য লড়ছেন বিরোধীরা, একথা বলতে দ্বিধাবোধ করেননি এই নেতা। আর এই কথার ভিত্তিতেই দেশের জাতীয় মিডিয়া খসড়ায় বাদ পড়া চল্লিশ লক্ষ নাগরিকদের 'বিদেশি' 'বিদেশি' বলে নিউজরুম উত্তপ্ত করে তুলে, যে বার্তা পৌঁছে যায় দেশের প্রান্তে প্রান্তে। আসামে চল্লিশ লক্ষ বিদেশিদের চিহ্নিত করা হয়েছে তা প্রচার করে দেশের অন্যান্য রাজ্যে রাজনৈতিক মুনাফার অঙ্ক চলছে আর অন্যদিকে এই চল্লিশ লক্ষকে এক বিশেষ জাতির ট্যাগ দিয়ে দেশের বিদ্বেষের রাজনীতিকে আর সবল করার তোলে হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবচিত্র ও পরিসংখ্যান সম্পূর্ণ অন্য কথা বলে।
আসামের বাঙালিদের নিয়ে এতো অপমান আমরা শুধু রাজনৈতিক ও ধর্মীয় কারণে সহ্য করে নিচ্ছি যা কিন্তু চরম লজ্জাজনক। উগ্র জাতীয়তাবাদ বাঙালিদের জন্য এতো ভয়ঙ্কর নয় যতটা ভয়ঙ্কর বাঙালির এই বিভীষণরা। এই দুর্বলতাই হচ্ছে আসামের বাঙালিদের সংকটের টার্নিং পয়েন্ট। এখানেই বাঙালিদের সংকট ও তার উত্তরণ লুকিয়ে আছে। নাগরিকত্ব বিষয়ক সমস্যা এনআরসির মাধ্যমে সমাধান হবে বলে অন্তত আশা রাখা যায় যেহেতু সুপ্রিম কোর্ট অতি সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে তা পরিচালনা করছে। তবে বরাকের বাঙালির নাগরিকত্ব সমস্যা ছাড়াও অহরহ একাধিক সমস্যার মোকাবিলা করতে হয়, কিন্তু গিরগিটি বাঙালিদের জন্য সব সংগ্রাম বুমেরাং হয়ে সমস্যাগুলো সমস্যাই থেকে যায়। এবং অতি কৌশলে এই সমস্যাগুলোকে হাতিয়ার করে চলে মাথাবিকানোর রাজনীতি। যতক্ষণ না বরাকের বাঙালিরা বাঙালি পরিচয়ে এগিয়ে এসে এগুলোর মোকাবিলা করবেনা ততক্ষণ বাঙালির দামী মাথায় কাঠাল ভাঙ্গা চলতে থাকবে। তাই সময় এসেছে গিরগিটি বাঙালিদের সনাক্ত করে এদের থেকে দূরত্ব বজায় রেখে চলা এবং ধর্মীয় ও ক্ষুদ্র রাজনৈতিক স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে বৃহত্তর বাঙালির স্বার্থে এগিয়ে আসা। এনআরসির মাধ্যমে আসামের বাঙালিদের 'বাংলাদেশি' অপবাদ মোচন কতটা হবে তা সময়ই বলবে তবে আমাদের মধ্যে যদি 'অউ দেখো বাংলাদেশি যার' মনোভাবটির কোন পরিবর্তন না আসে তবে বাঙালির সঙ্কট কখনো মোচন হওয়ার নয়।